বর্তমান সময়ের আতংকের অপর নাম ডেঙ্গু। প্রতি বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা তত বাড়ছে।
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা নিয়ে সবার মনে আতংক বিরাজ করছে। কিন্তু আতংকিত না হয়ে একটু সচেতন হলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আজ আমরা ডেঙ্গু নিয়ে সকল জানা-অজানা তথ্য আপনাদের জানানোর চেষ্টা করেছি।
ডেঙ্গু জ্বর কী : ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। এডিস এজিপ্টি নামক স্ত্রী মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হয়।
প্রাদুর্ভাব : ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু দেখা দিচ্ছে।
ইতিহাস : প্রাচীনকালে চীনের জিন রাজবংশে প্রথম ডেঙ্গুর মতো রোগের বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৮ শতকের শেষে তিনটি মহামারী আকারে ডেঙ্গুর আগমন ঘটে। এই তিনটি মহামারী কায়রো, ইন্দোনেশিয়া এবং পেনসিলভানিয়ায় ঘটেছিল।
১৭৮৯ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রথম ক্লিনিক্যাল বর্ণনা দিয়েছিলেন আমেরিকার চিকিৎসক বেঞ্জামিন রাশ।
এডিস ইজিপ্টিকে ডেঙ্গু রোগের বাহক হিসেবে শনাক্ত করেন অস্ট্রেলিয়ান প্রকৃতিবিদ টমাস লেন ব্যানক্রফট ১৯০০ সালে।
দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় ডেঙ্গুর আর্বিভাব ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে এবং পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
সংক্রমনের সময় : বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। জুলাই – অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। তবে বর্তমানে মার্চ মাস থেকেই ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং তা সারা বছর জুড়ে স্থায়ী হচ্ছে।
কখন কামড় দেয় এডিস মশা : আমরা ভাবি মশা হয়তো রাতে কামড় দিয়ে থাকে। কিন্তু এডিস মশা রাতে কামড়ায় না বরং ভোরে এবং বিকেলে এডিস মশা কামড় দেয়।
যেভাবে বুঝবো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি : এডিস মশা কামড় দেবার সাথে সাথে ডেঙ্গু জ্বর হয় না। বরং কামড়ের ৩-১৫ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন গুলো দেখা দেয়।
জেনে নেয়া যাক ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন :
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন গুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা : ১. সাধারন লক্ষন, ২. গুরুতর লক্ষন।
সাধারন লক্ষন :
# অত্যাধিক জ্বর। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে।
# মাংসপেশিতে ব্যাথা অনুভূত হওয়া।
# তীব্র মাথা ব্যাথা এবং মাথা ঘোরানো।
# বমি ভাব।
# চোখের পিছনে ব্যাথা করা।
# ত্বকের বিভিন্ন স্থানে লাল রংয়ের ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
# গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
এই লক্ষন গুলো সংক্রমনের ৪-১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয় এবং ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
গুরুতর লক্ষন :
# বার বার বমি হওয়া।
# পেট ব্যাথা করা।
# প্রসাব – পায়খানার সাথে রক্তপাত।
# নাক থেকে রক্ত পড়া।
# দ্রুত গতিতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া।
# ক্লান্তি ভাব।
প্ল্যাটলেটের সংখ্যা হ্রাস : ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়াবহ রুপ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্ল্যাটলেটের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। একজন সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির প্ল্যাটলেটের সংখ্যা ১,৫০,০০০-৪,৫০,০০০।
যখন এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে ডুকে তখন রক্তনালীতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে প্ল্যাটলেটের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্ল্যাটলেটের সংখ্যা ২০,০০০ এর নিচে নেমে যেতে পারে এবং মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ডেঙ্গু রোগীর যত্ন :
# বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে।
# ডাবের পানি, বিভিন্ন ফলের জুস রোগীকে একটু পর পর খাওয়াতে হবে।
# যেসব ফল ও শাক সবজি তে ভিটামিন-সি আছে সেসব ফল এবং শাক সবজি খাওয়াতে হবে।
# আয়রন রক্তেের প্ল্যাটলেট বৃদ্ধি করে। তাই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে দিতে হবে।
# জিংক সমৃদ্ধ খাবায় খাওয়াতে হবে।
# ডেঙ্গু জ্বরের একটা উপাদেয় ফল হচ্ছে পেঁপে।
# দিনে এবং রাতে মশারী টানিয়ে ঘুমাতে হবে।
কখন হাসপাতালে নিতে হবে : ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে তা কিন্তু নয়। বরং ডেঙ্গু জ্বরের ধরন বুঝে চিকিৎসা নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের ৩টি ধরন রয়েছে। যথা :
# ধরন “এ” : এ ধরনের রোগীদের সাধারণ জ্বর থাকে। এদের হাসপাতালে ভর্তি হবার দরকার নাই।
# ধরন “বি” : এক্ষেত্রে রোগীর জ্বরের সাথে সাথে বমি, প্রচুর পেট ব্যাথা, খাওয়ার অরুচি হতে পারে। এদেরও হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজন নাই।
# ধরন “সি” : যেসব রোগীদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের গুরুতর লক্ষন গুলো দেখা দেয় তারা ধরন “সি” এর অন্তর্ভূক্ত। এদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা :
# প্রত্যেকের বাসা এবং তার আশেপাশের সকল জায়গা সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
# খাল,বিল,ডোবা, নর্দমা, নালার ময়লা পানি পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত।
# খোলা পাত্র, নারিকেল খোল, ডাবের খোল, গাছের টব, এসির পিছন অংশ কোথাও পানি জমতে দেয়া যাবেনা।
# এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই কেনভাবেই কোথাও পানি জমতে দেয়া যাবেনা।
# কোনো জায়গায় মশার লার্ভা দেখলে সাথে সাথে ধংস করতে হবে।
# নিয়মিত মশা মারার স্প্রে ছিটাতে হবে।
# এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র গুলোকে নষ্ট করতে হবে।
# বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি যেন জমে না থাকে সেদিকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
আতংকিত না হয়ে একটু সচেতন হলেই আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারবো। আসুন নিজে সচেতন হই এবং অন্যকেও সতর্ক করি ; মিলেমিশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করি।